শেখ মুজিবুর রহমানঃ বঙ্গবন্ধু ও সোনার বাংলা

পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানী - গুনী ব্যাক্তি রয়েছেন যাঁরা চিরস্মরণীয়। আমাদের প্রিয় নেতা রাজনীতির মহাকবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই রূপ চিরস্মরণীয়। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, স্বাধীন ও স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যাঁর ভূমিকা বাঙালি জাতি আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে, যাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ এবং যাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা না থাকলে কোনদিন' বাংলাদেশ 'নামে একটি দেশ, একটি মানচিত্রের জন্ম হতো কিনা সন্দেহ তিনিই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবুর রহমানঃ বঙ্গবন্ধু ও সোনার বাংলা
শেখ মুজিবুর রহমানঃ বঙ্গবন্ধু ও সোনার বাংলা


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধনীর দুলাল নন। তিনি বিলেতে বড় বড় কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয়েও লেখাপড়া করেন নি। তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। 


জন্ম ও বংশ পরিচয় 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম - শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম শাহেরা খাতুন। তারা চার বোন ও তিনি দুই ভাইদের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। তার বয়স যখন দশ বছর তখন তিন বছর বয়স্কা জ্ঞাতিভগ্নী ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। 


বাল্যকাল ও শিক্ষা 

তিনি গিমা ডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখা পড়া আরম্ভ।করেন। পরে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানেই তিনি ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ সালে  সেখান হতে বি.এ পাশ করেন। 

 


রাজনীতিতে আগমন

বি.এ পাশ করার পর হতেই তিনি রাজনীতিতে পূর্ণভাবে যোগদান করেন। ছাত্রজীবন হতেই তাঁর বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্ব, অদম্য সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়। হোসেন সোহরাওয়ার্দী একবার গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে আগমন করেন। বালক মুজিবুর রহমান মুরুব্বিদের নিষেধ সত্বেও স্কুলের যাবতীয় দাবি মন্ত্রিবাহাদুরের কাছে পেশ করে সাথে সাথে আদায় করে ক্ষান্ত হন।


মুজিবের এই সৎসাহস দেখে তিনি খুশি হলেন এবং পরবর্তী কালে তাকে রাজনৈতিক শিষ্য করেন। হোসেন সোহরাওয়ার্দী সবসময় তাঁকে কাছে রাখতেন। শেখ মুজিব অবিভক্ত ভারতে 'নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন ' ও নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।


পাকিস্তান আন্দোলনে ও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পড়াকালে তিনি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালিদের দাবী - দাওয়া আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেন। 


১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেয়। সেখানেই রচিত হয় ছাত্র জীবনের সমাধি। 


পরে ভাসানী সাহেবের সংস্পর্শে এসে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি সেই দলে যুগ্ম সম্পাদক ও পরে সাধারণ  সম্পাদক হন।  ভাসানী সাহেব ন্যাপ পার্টি করার পর মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। 


বঙ্গবন্ধুর অবদান 

'জেলখানা আমার বাড়ি ' একবার দুঃখ করে বলেছিলেন শেখ মুজিব। কথাটা মিথ্যে নয়। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে যেয়ে তিনি অনেক বার জেল খেটেছেন। তিনি বাংলার মানুষদের স্বার্থের দিকে নজর দিয়ে তাঁর ব্যাক্তিগত স্বার্থকে দিয়েছেন  জলাঞ্জলি। 


সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানিদের কবল থেকে রক্ষা করেন। তিনি ০৭ই মার্চের ভাষনে এদেশের জনগণকে জাগিয়ে তুলেন। তিনি বলেন- "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা। " ঐতিহাসিক ভাষনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন -" রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো।


এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। প্রত্যক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুল। যার যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। " তাঁর রেসকোর্স ময়দানের ০৭ই মার্চের ভাষন শুনে এদেশের মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর। তারপর দীর্ঘ ০৯ মাস যুদ্ধ করার পর বাংলার মানুষেরা ফিরে পায় ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে তাদের হারানো বাংলাকে। 


বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ গড়তে তিনি যে পরিশ্রম করেছেন তা ভোলার নয়। তাই জনগন খুশি হয়ে তাঁকে  উপাধি দেয় "বঙ্গবন্ধু " তিনি বাঙালি জাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র  ও স্বপ্নের সোনার বাংলা। 


স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও দেশ পুনর্গঠনে মুজিব 

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা ঝাঁপিয়ে পড়লে সেদিন রাতে ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং এদিন রাতেই পাকিস্তানি বাহিনীরা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে।


২৭ শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্তে মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। তারপর ১৯৭২ সালের ০৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে মুক্তি দেয়। ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছলে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংর্বধনা জ্ঞাপন করা হয়।


বঙ্গবন্ধু বিমান বন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ঢাকায় পৌঁছলে চারিদিক থেকে জয়ধ্বনি হতে থাকে - তোমার নেতা, আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। 


তিনি অতি অল্প সময়ে প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় ও জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করেন। ১০ ই অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে "জুলিওকুরী" পুরস্কারে ভূষিত করেন। 


বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন 

বহু রক্তের বিনিময়ে, বহু সংগ্রাম করে পেয়েছি আমরা এই বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। এই দেশকে সুখী -সুন্দর স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত করা এবং এই দেশের শিক্ষা, শিল্পে ব্যবসা, বানিজ্যে অর্থে সাহিত্য -সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধশালী দেশ হবে।


বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। বর্তমান গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল যমুনা নদীর উপর সেতু তৈরি করা তার এই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। যমুনা নদীর উপর তাঁর নামে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণ হয়েছে। 


বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা 

সুজলা-শুফলা-শস্যশ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক আশা এই দেশ সোনার বাংলায় রূপায়িত হবে। এবং তা সফল হয়েছে। বহু রক্তের বিনিময়ে। এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, হয়ে উঠেছে সোনার বাংলা। হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যে ভরপুর।


গ্রীষ্মের খরতাপে, বর্ষার মেঘে , শরতের আকাশে, হেমন্তের সোনালি ধানে, শীতের কুয়াশায় এবং বসন্তের ফুলে ফলে হয়ে উঠেছে সোনার বাংলা। 


শোকাবহ কলংকময় দিন 

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট তাঁর উচ্চভিলাসী সামরিক কর্মচারির হাতে মর্মান্তিকভাবেে সপরিবারে নিহত হন। কিন্তু ঘাতক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিসংবাদিত ভূমিকার জন্য জাতি আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।


তিনি মরেও অমর হয়ে থাকবেন এই পৃথিবীর বুকে। কবির ভাষায় বলতে গেলে - "যতদিন রবে পদ্মা মেঘনাগৌড়ি যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। "


সবশেষে বলা যায়- আমাদের প্রত্যকের কর্তব্য এই দেশকে সুখী ও  সুন্দর শান্তিপূর্ণ সোনার বাংলায় গড়ে তোলা এবং তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করা। সোনার দেশের সোনার মানুষ হিসেবে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাঁর স্বপ্ন পূরণ করা।