শেয়ার বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য সেরা ১০টি টিপস
শেয়ার বাজার বিষয়ক প্রাথমিক টিপস। একজন নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য অত্যাবশ্যকীয়। শেয়ার বাজার, বিনিয়োগ

বর্তমানে শেয়ার বাজার একটি বেশ আলোচিত বিষয়। রাস্তা, ঘাট, রিক্সা, চায়ের দোকন এমন সব স্থানেই এখন শেয়ার বাজার নিয়ে আলোচনা। এ যেন বাংলাদেশে শেয়ার বাজারের একটি রেঁনেসা।
ছাত্র-ছাত্রী, চাকরীজীবি, ব্যবসায়ী সব শ্রেণীর লোকের মধ্যেই এ আলোচনা চলছে। অনেকেই মনে করে যে, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করলেই লাভ নিশ্চিত।
এমন চিন্তুা ভাবনা বা লাভের আশায় অনেকেই বুঝে না বুঝে শেয়ার মার্কেটে প্রবেশ করে এবং বিনিয়োগ করে।
মার্কেটে নতুন বিনিয়োগকারীরা সাধারনত আগে যারা বিনিয়োগ করেছে তাদের কথা শুনে বা হাউজে বসে অন্যেরা যে শেয়ার কিনে তা দেখে দেখে (কিছুই না বুঝে) কেনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে এবং কি গুজব শুনেও কোম্পানীর শেয়ার কিনে থাকে।
আর বিপত্তিটা হয় তখনিই। কোন কিছু না বুঝে টাকা বিনিয়োগ করে যখন শেয়ারের দাম কমতে থাকে আর পূঁজি হারাতে থাকে তখন হতাশ হয়ে যায়।
আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন হয় যে, কেউ হয়তো বলল বা কারো নিকট হতে শুনেছে যে, অমুক শেয়ারটা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ডাবল হবে বা ৫০% লাভ হবে ইত্যাদি।
একথা শুনে বেশী লাভের আশায় আগের কেনা শেয়ার লসে বিক্রি করে নতুন শেয়ার কিনে থাকে। শেয়ার বাজারে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা সব কিছু এখানে আলোচনা করা হলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে।
সব নতুন বিনিয়োগকারী এমনকি অনেক পুরানো বিনিয়োগকারীদের জন্য এখানে কিছু টিপস আলোচনা করা হলো, যেগুলো মেনে চললে হয়তো কিছুটা উপকার হতে পারে।
তবে এখানে যা আলোচনা করা হলো সেগুলোই যে সব এবং এগুলো ফলো করলেই যে লাভবান হওয়া যাবে এমটা কিন্তু নয়।
তবে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হবে। শেয়ার মার্কেটে একটি কথা মনে রাখতে হবে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, এমন কোন ফরমূলা নাই যা প্রয়োগ করলে লাভ নিশ্চিত এবং এমন নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবে না।
১। ধৈয্যঃ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে লাভ করতে হলে প্রথম যে গুণটি একজন বিনিয়োগকারীর থাকা দরকার তা হলো ধৈর্য্য।
বিনিয়োগকারীর মূলধন, দক্ষতা, জ্ঞান, বিশ্লেষণ কৌশল যা-ই থাকুক না কেন; যদি ধৈর্য না থাকে তবে কোনভাবেই মার্কেট থেকে লাভবান হতে পারবে না।
ধৈর্য যেমন বিক্রির ক্ষেত্রে প্রয়োজন; ঠিক তেমনি কেনার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন। এছাড়া অধৈর্য্য হয়ে ঘন ঘন শেয়ার বেচাকেনা করলেও বা লস কাভার করতে গিয়ে বর্তমান শেয়ার লসে বিক্রি করে অন্য কোম্পানীর শেয়ার কিনল।
কেনার পরে ঐ শেয়ারের দামও যদি পড়ে যায় আবার অন্য শেয়ারের পেছনে ঘুরবে। এভাবে এ কোম্পানী, সে কোম্পানী না করে একটু ধৈর্য্য রাখলে দেখা যাবে আপনার কমে যাওয়া শেয়ারই হয়তো বেশী লাভ দিয়ে যেত।
তাই শেয়ার বাজারে একজন সফল বিনিয়োগকারী হতে হলে এই প্রধান সম্পদ থাকতে হবে।
২। কোম্পানী বিষয়ে জানাঃ একজন বিনিয়োগকারী যে কোম্পানীতে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক, সে কোম্পানী বিষয়ে ভালভাবে জানতে হবে।
কোম্পানী বিষয়ে যে বিষয়গুলো প্রাথমিক ভাবে জানা দরকার সেগুলো হতে পারে কোম্পানীটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মার্কেটে কবে এসেছে, কি উৎপাদন করে বা সেবা দেয়, উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কেমন ইত্যাদি বিষয়গুলো আগে ভাল করে ষ্টাডি করতে হবে।
বিনিয়োগকারী কোম্পানী বিষয়ে বিস্তারিত জানলে বিনিয়োগ করে লাভ করতে পারবে বা সঠিক কোম্পানীতে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
বর্তমানে এমন অনেক বিনিয়োগকারী আছে যারা কোম্পানীর নাম ব্যতিত আর কিছুই জানে না। যেমন অনেকে বেক্সিমকো’র শেয়ার কিনেছে, কিন্তু বেক্সিমকো কি তা জানে না।
আর একটা কোম্পানী কি কাজ করে, ব্যবসার ধরণ কি, ইত্যাদি না জানলে বিনিয়োগ করে লাভের চেয়ে লোকসানই হবে।
৩। কারা কত পার্সেন শেয়ারের মালিকঃ যে কোন কোম্পানীর শেয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি বা মালিকদের হাতে থাকে।
কোন কোম্পানীর শেয়ার কোন মালিকদের হাতে বেশী বা কম তার উপর কোম্পানীর শেয়ারের চাহিদা ও মূল্য নির্ভর করে।
কোম্পানীর শেয়ার সাধারণতঃ স্পন্সর বা ডিরেক্টর, সরকার, প্রতিষ্ঠান, বিদেশী বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের হাতে থাকে। বর্তমানে ডিএসই’র নিয়মানুযায়ী স্পন্সর বা ডিরেক্টরদের হাতে ৩০% শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক।
কোম্পানীর বাকি শেয়ার সরকার (যদি থাকে), প্রতিষ্ঠান, বিদেশী বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকে।
খেয়াল করতে হবে যদি সরকার, প্রতিষ্ঠান, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যদি বেশী সংখ্যক শেয়ারের মালিক হয় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কম শেয়ার থাকে তবে কোম্পানী ভাল।
আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কম শেয়ার তবে মনে করতে হবে কোম্পানীটি ভাল। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে শেয়ার কম থাকায় কেনার যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশী থাকে এবং মূল্য বাড়তে পারে।
আমি এখানে একটি কোম্পানীর উদাহরণ দিচ্ছি। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমি এ কোম্পানীর পক্ষে কোন প্রচার করছি বা আপনি আমার কথায় ঠিক ঐ কোম্পানী বা এ ধরণের কোম্পানীর শেয়ার কিনবেন। ব্রিটিশ আমেরিকা টোবাকো কোম্পানী।
এই কোম্পানীর শেয়ার ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত স্পন্সর বা ডিরেক্টরদের হাতে ৭১.৯১%, সরকারের হাতে ০.৬৪%, প্রতিষ্ঠানের হাতে ১১.৯৭%, বিদেশেী বিনিয়োগকারীদের হাতে ৯.১৫% এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে মাত্র ৫.১১% শেয়ার।
বিনিয়োগকারীরা এ ধরণের বিশ্লেষন বা তথ্য বের করে দেখেতে পারেন।
৪। খবরঃ কোম্পানীর খবরের দিকে নজর রাখতে হবে। কোম্পানীর বিভিন্ন খবর প্রকাশ করে থাকে। যেমনঃ কোম্পানীর কোন নতুন প্রকল্প আছে কিনা, কোন নতুন চুক্তি কারো সাথে হবে কিনা, প্রতি কোয়ার্টারে ইপিএস, আয় ব্যয়, গত বছরের সাথে তুলনা করে দেখানো যে কোম্পানীর আয় তুলনামূলকভাবে বাড়লো না কমলো ইত্যাদি।
কিছু খবর দৈনিক পত্রিকায় বা কোম্পানীর ওয়েবসাইটে বা ডিএসই’র ওয়েব সাইটেও পাওয়া যায়।
৫। কোম্পানীটি বর্তমানে কোন ক্যাটাগরীরঃ শেয়ার মার্কেটে তালিকাভূক্ত কোম্পানীগুলোর মান ও পারফরমেন্স অনুযায়ী ডিএসই ক্যাটাগরী নির্ধারন করে থাকে।
যেমনঃ এ, বি, এন জেড। এ ক্যাটেগরিতে নির্ধারণের জন্য কতগুলো সূচক আছে। সবচেয়ে ভাল হলো এ ক্যাটেগরির কোম্পানী সবচেয়ে ভাল এবং জেড কোম্পানীর কোম্পানীগুলো তালিকার শেষে।
ক্যাটেগরী নিয়ে পরবর্তীতে বিশদ আলোচনা করা হবে।
৬। বার মাসের মূল্য রেঞ্জঃ একটি কোম্পানী বিষয়ে অনেক তথ্যই একজন বিনিয়োগকারীদের জানতে হয়। কারণ টাকা বিনিয়োগকারীর।
লাভ বা লস যা হোক না কেন তাতো বিনিয়োগকারীরই হবে। একটি কোম্পানীর শেয়ার কেনার পূর্বে দেখা প্রয়োজন যে গত ১২ মাসে শেয়াররে দাম সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন কত ছিল, কোন মাসে শেয়াররে দাম বেশী ছিল, কোন মাসে শেয়ার বেশী বেচাকেনা হয়েছে ইত্যাদি।
এগুলো দেখে এবং বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগকারী কখন ঐ নির্দিষ্ট কোম্পানীর শেয়ার কিনবে তা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এখানে ব্রিটিশ আমেরিকা টোবাকো কেম্পানী’র শেয়ারের দাম তুলে ধরা হলো।
১২ আগষ্ট ২০২১ পর্যন্ত ঐ কোম্পানীর সর্বনিম্ন দর ছিল ৫১৮ টাকা এবং সর্বোচ্চ দর ছিল ১৭৯৯.৭০ টাকা। এমন আরো অনেক তথ্যই একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের পূর্বে জেনে নিতে পারে।
তাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি হয়তো কম থাকবে।
৭। কোম্পানীর ইয়ার এন্ডিংঃ প্রতিটি কোম্পানীর একটি আর্থিক বছর আছে। আর্থিক বছরের হিসাব বছর শেষে করা হয়।
যেমন ব্যাংক এবং অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বছর শেষ হয় জুন মাসে এবং বাকী কোম্পানীগুলোর বছর শেষ হয় ডিসেম্বর মাসে।
আর্থিক বছর শেষ হওয়ার সাধারণত ২/৩ মাসের মধ্যে চূড়ান্ত হিসাবান্তে ঐ কোম্পানীর ডিভিডেন্ট ঘোষনা করা হয়। ভাল ডিভিডেন্ট পাওয়ার আশায় বিনিয়োগকারীরা এই ২/৩ মাসে নজর রাখতে হয়।
কেননা ডিভিডেন্ট ঘোষনার এই সময়ে শেয়ারের দাম বাড়তে পারে। তাই দাম বাড়ার আগে হিসেব করে এ সময় শেয়ার কেনা যেতে পারে।
এতে হয় ভাল ডিভিডেন্ড পাওয়া যায় বা ভাল ডিভিডেন্ড কোম্পানী ঘোষনা করলে শেয়ারের দাম বেড়ে যেতে পারে।
এতে হয় ডিভিডেন্ড দিয়ে অথবা শেয়ারের দাম বাড়লে বিক্রি করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কোম্পানীগুলোর আর্থিক বছর কখন শেষ এবং কখন ডিভিডেন্ড ঘোষনা হতে পারে সে দিকে নজর রাখতে হবে।
৮। ডিভিডেন্টঃ একটি কোম্পানী কোন বছর কত পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড দিয়েছে তা জানা দরকার। কোন কোম্পানী গত ৫/৭ বছরে কত পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড দিয়েছে তা ডিএসই ওয়েবসাইট বা কোম্পানীর ওয়েব সাইটে গিয়ে জানা যাবে।
আবার ডিভিডেন্ড নগদ না কি বোনাস দেয়া হয়েছে, রাইট শেয়ার দিয়ে থাকলে কোন বছর দিয়েছে এসব কিছুই একজন বিনিয়োগকারীকে জেনে রাখা ভাল। নগদ বা ক্যাশ ডিভিডেন্ড কোম্পানীগুলোর মৌলভিত্তি ভাল।
৯। কোম্পানিটি ঋণ আছে কিনাঃ কোম্পানীতে বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানীর আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ করে ঋণের বিবরণী ভাল করে জানা দরকার।
কোম্পানী কত টাকা ঋণ আছে, ঋণ কি দীর্ঘ মেয়াদী না দীর্ঘ মেয়াদী, ঋণের সাথে কোম্পানীর প্রকৃত সম্পদ মিলেয়ে নেয়া যেতে পারে এবং এ বিশ্লেষণ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।
১০। প্রাথমিক অবস্থায় সর্বোচ্চ ৫-৭ টি বাছাইকৃত কোম্পানীত বিনিয়োগঃ প্রথম অবস্থায় মার্কেটে প্রবেশ করলে বেশ একটা দ্বিধা দন্দ্ব থাকে যে কোন কোম্পানীতে বিনিয়োগ করব বা কোনটায় করবো না।
অর্থাৎ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। কতগুলো কোম্পানীর শেয়ার কিনবে, নাকি সব কোম্পানীর শেয়ার অল্প অল্প করে কিনবে এমন অস্থিরতায় ভোগে।
আবার বন্ধু, পরিচিত লোক, এমন বিভিন্ন জনের নিকট থেকে শুনে বা ব্রোকার হাউজে বসে অন্যেরা যা কিনছে, তাদের দেখে দেখে শেয়ার কেনা ইত্যাদি বেশ একটা হ-য-ব-র পোর্ট ফোলিও হয়ে যায়।
কোনটা রেখে কোনটা সামলাবে। তাই প্রাথমিক অবস্থা ভাল হয় যদি ৫-৭টি কোম্পানী বাছাই করে বিনিয়োগ করা এবং আস্তে আস্তে অভিজ্ঞতা বাড়লে এর সংখ্যা বাড়ানো যাবে।
প্রিয় পাঠক, এমন অনেক অনেক টিপস আছে। এখানে মাত্র প্রাথমিক কয়েকটি সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হলো। শেয়ার বাজার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের একটি বিশাল সমুদ্র।
তাই এখানে আলোচিত টিপসগুলোই যে সব বা এগুলো অনুসরণ করেই বিনিয়োগ করবে তা কিন্তু নয়।
শেয়ার বাজারে লাভ করতে হলে অনেক পড়াশোনা করতে হবে, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে এবং অর্থনীতি জানতে হবে। তবে শেয়ার বাজারে প্রবেশের জন্য এবং প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর জন্য টিপসগুলো আশা করি।
আরও পড়ুনঃ ভিজুয়ালি জনপ্রিয় কিছু ব্যবসা যা এখনি শুরু করতে পারেন