সাইকোসিস: অত্যন্ত গুরুতর মানসিক সমস্যা সম্পর্কে জানুন
মানসিক রোগ আমাদের সমাজের একটা বিশাল অংশ। মানুষ এখনো মানসিক রোগ সম্বন্ধে সচেতন না। একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন এর জন্যে শারীরিক সুস্থতা যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা। তাই আজ আমরা আপনাদের একটি মানসিক রোগ সম্পর্কে জানাবো। অবশ্যই শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।

সাইকোসিস কাকে বলে?
সাইকোসিস হল একটি অত্যন্ত গুরুতর মানসিক অসুস্থতা যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি হ্যালুসিনেশন (দৃষ্টিভ্রম) বা ডিলিউসনে (বিভ্রম) ভোগেন এবং বাস্তব জগতের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেন।
এটি একটি কঠিন সমস্যা যার দ্রুত চিকিৎসা হওয়ার প্রয়োজন। কারণ সাইকোসিসের রোগীরা নিজের ও আশেপাশের মানুষদের জন্য বিপদ সৃষ্টি করতে পারেন।
সহজভাবে বলতে গেলে, সাইকোসিস হলো সেই সমস্যা, যেখানে একজন মানুষ তার চারদিকের পরিবেশের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারেন না। ইংরেজিতে বলে 'রিয়েলিটি ডিসটরশান'।
মানুষের সঙ্গে থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা, নিজস্ব এক জগতের ভেতর ডুবে থাকেন। চিন্তা, চেতনা, ভাবনা, আচার-আচরণ, কাজ, বিশ্বাস, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক সবকিছুতেই অসংলগ্নতা স্পষ্ট।
তাহলে এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
সাইকোসিসের অনেক নির্ধারক লক্ষণ এবং উপসর্গ আছে তার মধ্যে কিছু হল:
১. দৃষ্টিভ্রম
দৃষ্টিভ্রম বা hallucination হল সাধারণভাবে অস্বাভাবিক উপলব্ধি। এটি কোনো অলীক বস্তু দেখা সম্পর্কে মিথ্যা উপলব্ধি।
কোনো মানসিক রোগীর ক্রমাগত দৃষ্টিভ্রম হতে থাকে। একই সাথে অনেক ধরনের জিনিস দেখা সম্ভব এই রোগে।
বলা হয়ে থাকে আমরা স্বপ্নে আসলে এরকম অসংখ্য দৃষ্টিভ্রমের শিকার হই। তবে, অবশ্যই সেটি কোনো রোগের উপসর্গ নয়।
২. ভ্রম
ভ্রম বা delusion হল মিথ্যা বিশ্বাস। ভ্রমের উদাহরণ: রোগীর মনে হতে রোগীর আপনজন রোগীকে ঠকাচ্ছে, অথচ তেমন কোনো সম্ভাবনাই নেই বা তেমন মনে হবার কোনো কারণই নেই।
আবার রোগী একটি সাধারণ বিষয়কে অস্বাভাবিক একটি বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যবহার করতে পারে ইত্যাদি।
৩. ক্যাটাটোনিয়া
ক্যাটাটোনিয়া বা catatonia হল পেশী নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা। মানসিক রোগীরা এক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ কোনো কারণ ছাড়াই নাড়াতে থাকে। ৫-৯ শতাংশ মানসিক রোগীর এই সমস্যা থাকে।
৪. চিন্তার বিশৃঙ্খলা
চিন্তায়, অনুভবে এবং আচরণের অস্বাভাবিকতা হল চিন্তার বিশৃঙ্খলা বা thought disorder। এটি সাধারণত স্কিটসোফ্রিনিয়া এবং সাইকোসিসের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
শৈশবে এবং বয়ঃসন্ধিকালে যদি চিন্তার বিশৃঙ্খলা দেখা যায় তাহলে সেটি আজীবন থাকে। তবে, কাজের চাপে বা মানসিক চাপে যদি এই সমস্যা হয় তবে সেটি বেশি সমস্যার।
৫. এছাড়াও ঘুমের অভাব অথবা অতিরিক্ত ঘুম (নিদ্রা চক্রের ব্যাঘাত)
৬. অবসাদ বা বিষন্নতা
৭. উদ্বেগ
৮. মনযোগের সমস্যা
৯. পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি
১০. আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা অথবা প্রচেষ্টা। ইত্যাদি লক্ষণগুলোও দেখা যায়।
এর প্রধান কারণগুলি কি কি?
সাধারণত বংশে মানসিক সমস্যার ইতিহাস আছে এমন মানুষের সাইকোসিস ঘটার সম্ভাবনা বেশি। কয়েকটি ক্রোমোজোমের রোগের ফলেও সাইকোসিস হতে পারে। অন্যান্য সম্ভাব্য কারণগুলি হল:
১. মাদক সেবন
২. ঝঞ্ঝাটপূর্ণ এবং অবসাদগ্রস্থ পরিবেশ
৩. মস্তিষ্কের টিউমার
৪. পার্কিনসন্স বা হান্টিংটন্স রোগের মত মস্তিষ্কের রোগগুলি
৫. বাইপোলার ব্যাধি
৬. ডিলিউসনাল ব্যাধি
৭. সাইকোটিক ডিপ্রেশন
৮. স্কিজোফ্রেনিয়া
এটি কীভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
আক্রান্ত ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ ও উদ্দীপকের প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর যেকোন রকম সাইকোটিক বা মনোরোগের ব্যাধির নির্ণয়করণ নির্ভর করে।
চিকিৎসক রোগীকে অবস্থাটির পরবর্তী সাহায্য ও মূল্যায়নের জন্য মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠাতে পারেন।
এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যান্টিসাইকোটিক প্রকৃতির ওষুধ দেওয়া হয় যা দৃষ্টিভ্রম ও বিভ্রম কমাতে এবং বাস্তব জগৎ ও অবাস্তবের মধ্যে নিশ্চিত পার্থক্য বোঝাতে সাহায্য করে।
কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপির পরামর্শও দেওয়া হয়ে থাকে, এবং এইরকম সমস্যায় এগুলি সাহায্য করে, বিশেষত বাইপোলার ও সাইকোটিক অসুস্থতায় যেখানে একজন কাউন্সেলরের সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ রোগীকে স্বাচ্ছন্দ্য এবং বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত থাকার অনুভূতি দেয়।
সাইকোসিসের সঙ্গে লড়াই একটি কঠিন প্রক্রিয়া, এর জন্য প্রয়োজন দৃঢ়সংকল্প মনোভাব এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটানা সাহায্য ও সহায়তা প্রদানের জন্য পরিবারের সদস্যদের থেকে সহযোগিতা, কারণ এইরকম পরিস্থিতিতে সাধারণত রোগী ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়।
সাইকোসিস এমন একটি মনের অবস্থা যা কোনটি বাস্তব এবং কোনটি বাস্তব নয় এমন বিভ্রান্তির সাথে জড়িত।
সাইকোসিসের সময়কালে, মন বাস্তবের সাথে কিছু যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। এটাতে কেবল নিজেরাই নয়, আশেপাশেরদের জন্যও বিভ্রান্তি ও ভীতিজনক।
তাই এসব বিষয়কে কখনোই তুচ্ছ মনে করে এড়িয়ে যাবেন না। যত দ্রুত সম্ভব এর যথাযথ চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।
আরও পড়ুনঃ ওসিডি অর্থাৎ অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার সম্পর্কে জানুন