সিলেটের লোভনীয় ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় ৫টি খাবার

বাংলাদেশি রেস্তোঁরায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের কন্যার জন্মদিন উদযাপন সিলেটি রন্ধনশৈলীর জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়। ইতিহাসবিদ লিজি কলিংহাম তাঁর ২০০৫ সালের বই কারি এ বায়োগ্রাফি-তে লিখেছেন যে সিলেটি কারি রান্না "অবিকশিত ব্রিটিশ থালাকে" একটি নতুন স্বাদের বর্ণালীতে রূপান্তর করেছে। তাই আজ আমি আপনাদের সিলেটের খাবার সম্পর্কে জানাবো। জানতে হলে পড়তে থাকুন শেষ পর্যন্ত।

সিলেটের লোভনীয় ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় ৫টি খাবার
ফটো গ্রহণ করা হয়েছে thedailystar.net থেকে

ঊননবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইউরোপীয় এবং মুসলমানরা সিলেট অঞ্চলে বিস্কুট এবং ব্রেডের প্রচলন করেছিল যা মুসলিম সম্প্রদায়কে অত্যন্ত আকর্ষণ করে। এটি হিন্দুদের দ্বারা অনেক পরে জনপ্রিয়তা পায়।


লন্ডনে, ১৯৪০-এর দশকে কিছু উদ্যোগী সিলেটি ক্যাফে স্থাপন শুরু করে এবং মেনুতে তরকারী এবং ভাত রাখে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাবে বাংলাদেশীরা তাদের খাবারকে ভারতীয় হিসাবে উল্লেখ করে।


যুক্তরাজ্যে, ১০টিরও বেশি ভারতীয় রেস্তোরাঁর ৮টিই বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন। যার ৯৫% সিলেটি। ৮০% থেকে ৯০% ব্রিটিশ কারি-হাউস সরাসরি সিলেটের সাথে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও সিলেট তার রন্ধনশৈলী জন্য পরিচিতি পায় নি।


সিলেট অঞ্চলের রাঁধুনিরা ১৯৬০-এর দশক থেকে ব্রিটিশ তরকারীকে আরও বেশি পরিমাণে বিকশিত করেছে। সিলেটিদের দ্বারা উদ্ভাবিত চিকেন টিক্কা মশলাকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব রবিন কুক ২০০১ সাল ব্রিটেনের জাতীয় খাবার হিসাবে ঘোষণা দেন।


তাহলে চলুন সিলেটের এমনই ৫টি ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে জেনে আসি।


১. আখনি

সিলেট অঞ্চলে জন্ম নেয়া এই আখনি মূলত চাল দ্বারা তৈরি। সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিরিয়ানি বা পোলাও এমনকি খিচুড়ি তৈরিতেও আখনি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।


চালের সাথে মাংস মেশানো হয় এবং সেই মাংস অনুসারে আখনির প্রকারভেদ করা হয়ে থাকে। গরুর আখনি কিংবা খাসির আখনিই এসব অঞ্চলে বেশি জনপ্রিয়।


আখনির জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি ইফতারের আয়োজনে। সিলেট অঞ্চলের মানুষের নিকট অতি উপাদেয় এই খাবার ছাড়া তাদের ইফতার অসম্পূর্ণই বলা যায়।


আর এই আখনি গুলোর মূল্য খুব বেশি নয়। গরুর আখনি ২৭০ এবং মুরগির আখনি ২২০ টাকায় পাওয়া যায়। আপনারা এগুলো সিলেটের যেকোনো রেস্টুরেন্টে পাবেন।

রাজশাহীর ৫টি জনপ্রিয় খাবারের সন্ধান

জিভে জল আসার মতো খুলনার বিখ্যাত ৫টি খাবার

চট্টগ্রামের সেরা ৫টি রেস্টুরেন্টের লোভনীয় সব খাবার

আহ! পুরান ঢাকা মানেই সুস্বাদু আর লোভনীয় সব খাবার

দিল্লির লোভনীয় সেরা ৫টি বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় খাবার

কেরালার বিখ্যাত সুস্বাদু খাবারগুলি দেখলেই মুখে জল আসবে


২. চুঙ্গা পিঠা

চুঙ্গা পিঠা সিলেটিদের ঐতিহ্যবাহী খাবার। প্রতি বছর শীত মৌসুমে ভাপা, পুলি , মালপো পিঠার, সাথে পাল্লা দিয়ে চুঙ্গা পিঠাও স্থান পায়।


এই পিঠা তৈরি করতে প্রয়োজন হয় বিরইন চাল, নির্দিষ্ট জাতের বাঁশ। ভাল ভাবে চাল ভিজিয়ে নরম করে বাঁশের চুঙ্গার মধ্যে ভরে খরকুটা দিয়ে পুড়িয়ে এই পিঠা তৈরি করা হয়। গোলাকার আকৃতির এই পিঠা দুধের মালাই, খেজুরের গুড় ও দুধের সর দিয়ে খেতে সুস্বাদু।


এককালে সিলেটের পাহাড়ি আদিবাসীরা এক ধরনের বিশেষ বাঁশ কেটে চুঙ্গা বানিয়ে এর ভেতর ভেজা চাল ভরে তৈরি করত এক ধরনের খাবার।


কালক্রমে এ খাবার পাহাড়ি আদিবাসীদের আস্তানা ছেড়ে চলে এসেছে সিলেটবাসীদের ঘরে। কালের বিবর্তনে চুঙ্গা দিয়ে তৈরি করা খাবার এখন চুঙ্গা পিঠা নামে বহুল পরিচিত।


এই পিঠা এখন সিলেট বিভাগ ছাড়িয়ে চলে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে, আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে। সারাদেশে এ পিঠার কদর বাড়ছে।


আপনারা যদি সিলেট ভ্রমণে যান তবে পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টের এই খাবারটি অবশ্যই একবার হলেও স্বাদ গ্রহণ করবেন। এর মূল্য খুব বেশি নয়। বেশ সহজলভ্য দামে পেয়ে যাবেন এই খাবারটি।


৩. চিকেন টিক্কা মাসালা

চিকেন টিক্কা মাসালা মূলত চিকেন টিক্কা, এবং মুরগির ছোট ছোট টুকরোকে মশলা এবং দই দিয়ে মেরিনেট করে তৈরি করা হয়। একধরণের সস সাধারণত ক্রিমযুক্ত এবং কমলা রঙযুক্ত এই তরকারি রান্না করতে ব্যবহৃত হয়।


খাদ্য, পুষ্টি এবং ডায়েটটিক্সের মাল্টিকালচারাল হ্যান্ডবুক ১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশী অভিবাসী শেফদেরকে এটি তৈরির মর্যাদা দিয়েছে। মোগর টিক্কা মাসালা সারা বিশ্বের রেস্তোঁরাগুলিতে পরিবেশন করা হয়।


আপনারা এই অসাধারণ লোভনীয় খাবারটি ১১০ টাকা মূল্য পেতে পারেন।


৪. হাঁস বাশ

হাঁস-বাশ হাঁসের এবং বাঁশের অঙ্কুর দ্বারা তৈরি এক ধরণের তরকারি। যদিও এটি তরকারি হিসাবে সব জায়গায় প্রচলিত না তবে এটি সিলেটি রান্নার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এবং সুস্বাদু খাবার।


এটি ভাত বা তন্দুর রুটি দিয়ে খাওয়া হয়। হাঁস-বাশ তরকারি স্বাদে কম ঝাঁঝালো। সিলেটের খাবারের মধ্যে এটি অন্যতম একটি সুস্বাদু খাবার।


যরা একবার হাঁস-বাঁশের রান্না খেয়েছেন, তাঁরাই এর স্বাদের গুনাবলী বুজতে পেরেছেন। তবে অনেক সিলেটিরাই এটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না।


বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের অনেকেই এ মজাদার খাবার সম্পর্কে জানে না। তার প্রধান একটি কারণ বাঁশের মোচা বা সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় ‘করিল’ এর সল্পতা।


কচি বাঁশ খাদ্য হিসেবে খেতে শুরু করছিল কারা বা কোন জনগোষ্টি তা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমান থেকে পাওয়া যায় চাইনিজদের খাদ্য হিসেবে কচি বাঁশ খাওয়ার ইতিহাস বেশ পুরোনো।


পরে ধীরে ধীরে চাইনিজদের থেকে কচি বাঁশ খাওয়ার প্রবনতা ছড়িয়ে পরে অন্যান্য জনগোষ্টিতে। বিশেষ করে মোঙ্গলদের মধ্যে।যাযাবর মোঙ্গলয়েডদের কাছ থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য জনগোষ্টিতে।


বর্তমানে এই কচি বাঁশ বা কোরল বিভিন্নদেশের বিভিন্ন জনগোষ্টির খাবারের মধ্যে প্রচলন রয়েছে। তবে নির্দিষ্টভাবে বলার তেমন উপায় নেই যে বাঁশ কোড়ল আসলে চায়নিজ, মোঙ্গল বা সিলেটিদের খাবার।


৫. সাত রং চা

সাত রং চা হচ্ছে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় উষ্ণ পানীয়। চায়ের এই স্বাদ নিতে চা প্রেমীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন।


শরবত-মিষ্টি স্বাদ থেকে শুরু করে ঝাঁঝালো লবঙ্গ সহ প্রতিটা স্তরের আলাদা আলাদা স্বাদ রয়েছে এবং বর্ণের দিক থেকে রংধনুর মতো বর্ণীল।


সাত রং চা নীলকণ্ঠ টি কেবিনে পাওয়া যায়, একটি বিখ্যাত চায়ের দোকান, যা শ্রীমঙ্গল, সিলেটে অবস্থিত। রমেশ রাম গৌড় হচ্ছেন এই সাত রং চায়ের উদ্ভাবক।


সাত রং চায়ের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ এবং স্বাদ রয়েছে। রংধনুর সাতটি আলাদা আলাদা রং দিতে রমেশ রাম গৌড় এক স্তরের উপর আরেক স্তর ঢেলে দেন।


সাত রং চায়ের উপরের স্তরটি দারুচিনি স্বাদের হয়ে থাকে। যেখানে এর নিচের স্তরটি লেবু স্বাদ প্রদান করে। চতুর্থ স্তরে ঘনীভূত দুধের সাথে কালো চা থাকে, যখন নিচের স্তরগুলোতে মিষ্টি, লবঙ্গ সহ শরবত সবুজ চা, দারুচিনি এবং গোপন মশলা থাকে।


এটা খুব কমই শুনা যায় যে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে কেউ সাত রং চা পান না করে এসেছেন। এমনকি শ্রীমঙ্গলে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার কর্মকর্তাদের নিয়ে রমেশ রাম গৌড়ের বিখ্যাত চা পান করে এসেছেন।


এখানে শুধু সাত রঙের চা নয়, পাঁচ ও দুই রঙের চা-ও পাওয়া যায়। সাত রঙের চা ৮০ টাকা, পাঁচ রঙয়ের চা ৬০ টাকা এবং দুই রঙয়ের চা ৪০ টাকায় পাওয়া যায়।


এই ছিলো সিলেটের বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার। আপনারা সিলেট ভ্রমণ করলে অবশ্যই এই খাবার গুলো খেয়ে দেখবেন।


আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো স্থানের খাবার নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।


আরও পড়ুনঃ ভোজন রসিকদের জন্য রাজশাহীর ৫টি জনপ্রিয় খাবারের সন্ধান