সুর্দশনার প্রেম
আজ সকালে নিলু শহর থাকিয়া বাড়িতে আসিয়াছে। কিন্তুু শহর থাকিয়া নিলু আসিয়া বাড়িতে এক মুহুত থাকে নাই। নিলুর বাল্য বন্ধু রাখাল দাস ও মোহন লালের সহিত দেখা করার জন্য। জৈষ্ঠ্য মাসের তীব্র রোদে ছাতা না নিয়ে বাহিরে বের হইল।

এক. সেই কাল ধরিয়া নারী জাতের সাথে চলাফেরা করিয়া আসিতেছি' নারী জাতের আচার ব্যবহার সব চেনা "কিন্তুু হটাৎ করিয়া কি যে হইল উহা বুঝিতে পারিলাম না " প্রথম বার নারী জাতকে চিনতে ভুল হইল "এ ভুলের মাশুল হয়তো মৃত্যু পযন্ত সহিতে হইবে "হয় তো কোন জন্ম পাপ কার্য করিয়াছি "সেই পাপের বোঝা এ জন্ম ভোগ করিতেছি, সুর্দশনাকে যেদিন শিমুল গাছের গোড়ায় বসে থাকতে দেখেছি "কিন্তুু বসে থাকিয়া শেষ নহে, তার দুই চোখ বেয়ে অঝরে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল ' অগোছালো মাথার চুল, জ্যৈষ্ট মাসের তীব্র রোদে সুদর্শনার মুখ লাল রক্ত বর্ণ ধারন করিয়াছে "এমন চাঁদের মত মুখ খানিতে যদি অমন বিকৃতি আকার ধারন করিয়া থাকে "ইহা সুর্দশনার চেহারার সাথে কিরুপে দেখায় " এমন দৃশ্য দেখিয়া নিলু আর দুরে থাকতে পারল না,
আজ সকালে নিলু শহর থাকিয়া বাড়িতে আসিয়াছে। কিন্তুু শহর থাকিয়া নিলু আসিয়া বাড়িতে এক মুহুত থাকে নাই। নিলুর বাল্য বন্ধু রাখাল দাস ও মোহন লালের সহিত দেখা করার জন্য। জৈষ্ঠ্য মাসের তীব্র রোদে ছাতা না নিয়ে বাহিরে বের হইল।
স্ব জ্ঞানে স্ব বুদ্ধি লইয়া ব্যাকুল হইয়া নিলু সুর্দশনার নিকট উপস্থিত ইহল , কাছে আসিয়া নিলু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল "নিলু কি করিবে সেই কার্য খুঁজিয়া পাইতেছে না "নিলু কি কাছে গিয়ে সুর্দশনার চোখের জল মুছে দিবে "নাকি মাথার অগোছালো চুল হাত দিয়া সরিয়ে দিবে "কোন কর্ম খুঁজি না পাইয়া, নিলু নিরুপায় হইয়া কাঙালের ন্যায় সুর্দশনার নিকট দাঁড়িয়ে রইল "আশেপাশের আবাদি জমি জৈষ্ঠ মাসের তীব্র খরায় পুড়ে ছাই হইয়া গেছে "নদী- নালা শুকিয়ে মরুভুমির মত পরিণত হয়েছে , অলস. রাখালরা কোন কর্ম না পাইয়া, গাছের নিচে বসিয়া বিরহের সুর তোলে "সকল জমি পুড়িয়া ছাই হইছে, বিন্দু পরিমাণ তৃণ পড়িয়া রয় নাই, গরু গুলো না খেতে পেয়ে চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে "বুকের হাড় গুলো হাতে গোনা যায় এক দুই. করিয়া "কিছু লোক গামছা পাতিয়া বসিয়া থাকে গাছের নিচে, অপেক্ষা করিতে থাকে মৃদু বাতাসের জন্য "কিন্তুু প্রকৃতির চারিদিক. স্তব্ধ. হইয়া রইল!
দুই. সু্র্দশনা চোখের জল মুছে নিলুর দিকে তাকিয়ে রইল মলিন বদনে। এমন ভাবে চেয়ে রহিল যেন কত জনমের চেনা আপন জন। নিলু ও সুর্দশনা একই গ্রামের কিন্তুু কেউ কোনদিন কাহারো সহিত একটা বাক্য বলিছে, ঠিক মনে পড়ে না। তাহার দুজনে জাতে ভিন্ন। সুর্দশনা বলিল, নিলু তুই. এই খানে কিছু বলবি নাকি। নিলু মাথা নেড়ে জবাব দিল! সুর্দশনা বলিল, কি কথা বলবি বলিয়া ফেল। গ্রামের লোক দেখিলে অযথা দুর্নাম রটাবে। ইহা লইয়া পরে গ্রামের মধ্যে গোল যোগ পড়িয়া যাইবে।
আমাদের এই অশিক্ষিত অভদ্র সমাজ এরুপ কার্য করিয়া থাকে। তাহারা না বলিয়া বা কি করিবে, কারণ তুই জাতে অন্য আবার অবিবাহিত পুরুষ।
নিলু বি এ পাশ করিয়া শহরে চাকরি করে । কি কারণে না জানি নিলু গ্রামে ফিরিয়া আসিল। নিলুর বাপ গ্রামের স্বনামধন্য লোকের মধ্যে একজন। তাহার কথা সবাই মানিত। কাহারো যদি কিছু দরকার হইত, তার নিকট আসিত। নিলু সাহস করিয়া সুর্দশনার দিকে তাকিয়ে বলিল, সুর্দশনা তোর কি হয়েছে। রোদে গাছের নিচে বসিয়া কাঁদিস কেন। নিলু বলিল, উহার কারণ কি "জানিতে পারি। সুর্দশনা কহিল অবশ্যই জানিতে পার। ইহা লুকিয়ে রাখার মত কিছু নহে! সুর্দশনা কহিল, সুখে থাকিলে কেউ কোনদিন একা বসিয়া কাঁদে না নিলু। সু্র্দশনা এবার উঠিয়া দাঁড়াল,মাথার এল মেল চুল ঠিক করিতে লাগিল।এরুপ দৃশ্য নিলু অবুঝ বালকের ন্যায় চাহিয়া রহিল!
তিন. সুর্দশনা কহিল, নিলু তুই তো অনেক পড়াশুনা করেছিস! নিলু মাথা নেড়ে জবাব দিল। সুু্র্দশনা কহিল, মানুষ বিপদে পড়লেই কেবল কাঁদে! নিজের দুঃখ পরজনকে বলিয়া কিল লাভ! নিলু পারবি কি তুই আমার অতীতের সব ব্যথা মুছে দিতে! নিলু বলিল, বলিয়া দেখ তো আগে, কিছু করিতে পারি কি। সুর্দশনা কহিল, নিলু তুই তো মনে টয় জানিস!আমার বিয়ে হয়েছে তিন মাস আগে! সুর্দশনার বিয়ের কথা শুনিয়া নিলু চমকে উঠল, কি তোর বিয়ে হয়েছে! মায়ের কথা রাখতে গিয়ে আমাকে বিয়ে করিতে হইল! বিয়ে করিয়া কি জীবনে সুখ পাইছি। সে কথা মনে পড়ে না।
যেটুকু সুখ পাইছি, সে সুখের কথা মনে পড়ে না! কখন যে কালো মেঘের আড়ালে ঢেকে গেছে বুঝতে পারলাম না! মা আমারে জোর করিয়া বিবাহ দিল জমিদার বাড়ি দেখিয়া। তাদের অনেক অর্থ সম্পদ আছে! সুর্দশনা তুই বিয়ে করলে অনেক সুখে থাকতে পারবি! মানুষের টাকা পয়সা থাকলে কি সুখী হয়, এ কথা আমি মানি না। মা আমারে যার সাথে বিবাহ দিয়েছে সে একটা মাতাল!
সারাদিন জুয়ার আসরে পড়িয়া থাকে। সারাদিন পার করিয়া ঘরে ফিরে আসে রাতের বেলা। সারা শরীরে মদের গন্ধ আর অসহ্য মুখের বাক্য! কিছু কহিতে গেলে এলোপাথাড়ি ভাবে মারধর করে! এমন ভাবে পাঁচ মাস কেটে যাওয়ার পর আর সইতে না পেরে বাড়ি চলিয়া আসিয়াছি! নিলু এতক্ষণ চুপ হইয়া দাঁড়িয়ে সুর্দশনার কথা শুনছিলাম! নিলু এবার মুখ খুলিলেন, বলল সুর্দশনা ফের যদি তোরে নিতে আছে তোর স্বামী।
সুর্দশনা কহিল, সে আসিলেই কি আমারে নিয়ে যেতে পারবে! সু্র্দশনা বলিল, সেই কথা ভাবিতেছি কেমন করিয়া বাকি জীবন টা পার করিয়া দেই। কে নিবে অভাগার দেখাশুনার ভার। নিলু কহিল, সুর্দশনা যদি কিছু না মনে করিস, তাহলে একটা কথা বলিতে পারি! সুর্দশনা মলিন বদনে তাহার বাক্য প্রকাশ করিল!
চার. কি কথা বলবি বলিয়া ফেল! নিলু বলিল, আমি তোকে বিবাহ করিতে চাই! তুই যদি রাজি থাকিস খুলে বল সম্মুখে ! সুর্দশনা নিলুর কথা শুনিয়া হতবাক হইয়া গেল। কি বলিবে নিলুকে সুর্দশনা সেই ভাষায় হারিয়ে ফেলল। বিকট আওয়াজ করিয়া নিলুকে কি যেন বলিল, সুর্দশনার বাক্য কেহ বুঝিল না! সুর্দশনা ক্ষনিক পরে কহিলেন, কি তুই আমারে বিবাহ করিতে চাস।
ছিঃছিঃ গ্রামের লোক এ কথা শুনলে অনেক সমালোচনা করিবে গ্রামের মধ্যে। গ্রামের মধ্যে একটা ভেজাল সৃষ্টি হইবে। মুচির মেয়ের সাথে, বৈরাগীর ছেলের বিবাহ কিরুপে ঘটিয়াছিল থাকে । ছিঃছিঃ নিলু জাত ফাঁকতালে ভুলিয়া এমন কার্য করিতেছে। সে বি এ পাস করিয়া বাপের. মুখ উজ্জল করিয়াছে কিন্তুু এমন কার্য করিলে বাপের মান সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে! বিবাহ করিতে হইলে কি মুচিরামের মেয়েকে বিবাহ করবে!
গ্রামে কি তার জাতের মেয়ে আকাল পড়িয়া গিয়াছে। সুর্দশনা মুচিরামের মেয়ে উহা মানিয়া নিলাম, কিন্তুু সুর্দশনার একবার বিবাহ হইয়াছে! গ্রামের সকল লোক জানে সুর্দশনার বিবাহ হইয়াছে তিন চার মাস হইল। কিছু দিন সংসার করার পর সুর্দশনা তার নিজ গৃহে ফিরে আসিয়াছে। তার স্বামী নাকি ভাল না সারাদিন মদ আর জুয়া আসরে পড়িয়া থাকে আরো কত যে কি! সুর্দশনা যে অপকর্ম করিয়া স্বামীর বাড়ি থাকিয়া
আসিয়াছে, কেউ তার দিকে মাথা তুলে চেয়ে দেখে না।
কিন্তুু নিলু এ কার্য কেমনে করবে! নিলু এবার অন্তরের মধ্যে জমিয়ে রাখা কথা সুর্দশনার নিকট তুলে ধরল! সুর্দশনা তুই জানিস না তোকে আমি অনেক দিন ধরিয়া ভালোবাসি । সেই ছোট কাল থাকিয়া মনের মধ্যে একটা আশা ছিল। কিন্তুু উহা প্রকাশ করিতে পারি নাই! হয়তো জাতের কথা চিন্তা করিয়া, নয় তো বা বাপ মার কথা মনে করিয়া। তোর মা জোর করিয়া তোরে বিবাহ দিল জমিদার বাড়ি দেখিয়া। চোখের সামনে বউ সাজিয়ে নিয়ে গেল জমিদারের ছেলে পালকিতে করিয়া। কিন্তুু সেই সময় নিরুপায় হইয়া ছিলাম,
কিছুই করিতে পারি নাই! এবার কি কোন বাধা আছে, আমার মনে হয় না। সুর্দশনা কহিল, নিলু বাধা এখন ও আছে। নিলু আগ্রহ দেখিয়া বলিল, কি বাধা শুনি! সুর্দশনা কহিলেন, তোর বাপ মা যদি এ বিবাহ মানিয়া না নেয়, উহার ফল কিরুপ হইয়া দাঁড়াইবে। নিলু কহিলেন, সুর্দশনা পারবি কি এই কাঙালের হাত ধরিয়া শহরে চলিয়া যাইতে। তোর যদি আপওি না থাকে খুলে বল সম্মুখে। সুর্দশনা কহিল, আপওি করিয়া বা আর কি হইবে। সমাজের লোকের কথা ভেবে একা থাকিলে বেঁচে থাকা অনেক দায় হইয়া যাবে! সুর্দশনা আকুল হইয়া কহিল কবে বিবাহ করবি সেই কথা বল।
পাঁচ. নিলু কহিল, সময় হইলে এমনিতেই. জানিতে পারবি! মোহন লাল গিয়ে তোরে খবর দিবে। সুর্দশনা কহিল, মোহন লাল কেন বলিবে নিলু! তুই আমাকে বলিতে পারবি না। নিলু সাহস দেখিয়া বলিল, পারব না কেন বলিতে! নিলু কহিল, সুর্দশনা তুই বাড়ি গিয়ে তোর বাপ মা কে বলিয়া দেখ তারা কি বলে! নিলু বলিল, বাপ মার মনে কষ্ট দিয়ে কোন কাজ করা উচিত নহে! যে মা দশ মাস দশ দিন সযত্নে গর্ভে ধরিয়া রাখিল। সেই মা বোঝে প্রসব বেদনার কত জ্বালা সহ্য করিতে হয়।
সুর্দশনা বলিল, নিলু তুই ঠিক কথা বলেছিস। যে বাপ মা না থাকলে হয় তো পৃথিবীর মুখ দর্শন করিতে পারিতাম না। যদি কোন কারণে বাপ মায়ের মনে কষ্ট পায়, উহা ঈশ্বর ও সহ্য করিবে না। আমার প্রতি ঈশ্বর নারাজ হইবে। আর্শীবাদ করা দুরের কথ। আরো অনেক. যন্ত্রনা ভোগ করতে হইবে! নিলু চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে সুর্দশনার মুখের বাক্য শুনিতেছে। নিলু এবার মুখ খুলিলেন, সুর্দশনা এবার আমি যাই. অনেক বেলা হইছে! মোহন লালকে খুঁজিতে আসিয়া ছিলাম,
তার দেখা তো কথা পথে একটা লোক ও দেখলাম না! গ্রামের সকল ছেলে কি গৃহত্যাগী হইয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করিল নাকি। সুর্দশনা মৃদু হাঁসিয়া কহিলেন, না নিলু তাহারা গৃহ ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসে যাই নাই! তারা সকলে গ্রামের মধ্যে অবস্হান করিতেছে। সুর্দশনা কহিল,নিলু রাখাল দাস কে তুই চিনিস। কিছুদিন যাবত তাহার কঠিন ব্যামো বাধিয়াছে, কিছুতেই তাহা সেরে উঠে না! এখন অব্দি রাখাল দাস বিছানায় পড়িয়া আছে।
কত রওজা কত কবিরাজ বাবুরা আসিয়া তাকে দেখিয়া গেল! কিন্তুু কোন সুফল পাওয়া গেল না! তাই গ্রামের ছেলেরা মিলিত হইয়া উপায় বের করিল! নিলু বলিল কি উপায় শুনি সুর্দশনা! সুর্দশনা কহিল রাখাল দাসীকে শহরে নিয়ে যাবে! নিলু বলিল সেটা ভাল কথা, কবে নিয়ে যাইবে! সুর্দশনা বলিল, তা ঠিক কহিতে পারি না নিলু?
ছয়. নিলু কহিল, সুর্দশনা অনেক খিঁদে পাইছে এবার যাই। সুর্দশনা মলিন মুখে হাঁসিয়া কহিলেন, যা নিলু পরে দেখা হইবে! নিলু সুর্দশনার আদেশ পাইয়া জৈষ্ঠ্য মাসের রৌদ্রে তাপে হন হন করিয়া গৃহের দিকে চলিয়া গেল। সুর্দশনা কিছুক্ষণ নিলু পথ চলার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর সুর্দশনা নিজেই গৃহের দিকে গমন করিল! ধানের আইল দিয়া তিন চার বিঘা জমি পার হইলেই সুর্দশনাদের সেই ছোট্ট কুঠির!
সে ঘর দুই ভাগে বিভক্ত! মাঝখানে খড়ের ছন দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে ! এক রুমে তার মা বাপ থাকে! আর অন্য এক রুমে সুর্দশনা একাই নিজেই থাকে!
সুর্দশনাদের বাড়ির আশেপাশে ছোট খাট অনেক গাছগাছালিতে ভরা! রাতের বেলা যখন সূর্য দেবতার আলোর মহিমা নিভে যায়, ঠিক সেই সময় সুর্দশনানের বাড়ি অন্ধকার ঘনিয়ে নেমে আছে! সকাল না হওয়া পর্যন্ত তাদের গৃহের চিহ্ন ঠিক বোঝা যায় না! সুর্দশনার পরিবারে সদস্য সংখ্যা চার জন ছিল! তার মা বাবা ও দুই ভাই বোন! সুর্দশনার বড় ভাই গত বছরে কলেরা রোগে মারা যায়।
তার বড় ভাই বেঁচে থাকিতে তাদের পরিবারে অনেক শান্তি ছিল! বাপ ছেলে দুজনে মিলে রোজগার করিত! কিন্তুু সুর্দশনার ভাই মারা যাবার পর তাদের পরিবারে অশান্তি লেগে যায়! বর্তমানে সুর্দশনার বাপ একা রোজগার করিয়া সংসার চালায়। তাহার মাঝে সুর্দশনা স্বামীর বাড়ি ছাড়িয়া বাপের বাড়ি চলিয়া আসিল! থাক সে সব কথা বলিয়া আর কি হইবে, যা হবার তা তো ঘটিয়াছিল গিয়াছে!
সাত. বিধির বিধান তো খন্ডন করা যায় না! অনেক দিন পর নিলু শহর থাকিয়া গ্রামে আসিয়া কি ভুল কাজ করিয়াছে! নিলুর বাল্য বন্ধুর সাথেও দেখা মিলিল না। নিলু অবাক হইল, কি করিয়া হইয়া সম্ভব! তাহারা কি সকলে গ্রাম থাকিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া গেছে। এত ছোট গ্রাম একজন বন্ধুর দেখা পাইল না! নিলুর সব চাইতে ভাল বন্ধু মোহন লালকে তো দেখা পাওয়ার কথা।
মোহন লাল তো আমার আসার কথা শুনলে ছুটে আসত। রৌদ্রতাপে এমনিতেই. মাথা ঝিম ধরিয়া আসিতেছে। নিলু মনে মনে ভাবিল, মোহন লালের বাড়িতে কি একবার যাইবে! এমন রৌদ্র তাপে তার বাড়িতে যাওয়া উচিত হবে না! থাক রোদ একটু কমে আসুক বিকেল বেলা গেলে হবে! এরুপ কথা নিলু মাথার মধ্যে চিন্তা করিতে লাগিল! ক্ষনিক পরে রাস্তা থাকিয়া নেমে বাড়ির দিকে গেল!
এমন সময় পিছন থাকিয়া মোহন লাল ডাক দিল! নিলু দাঁড়া ঐ খানে আমি আসিতেছি। নিলু ডাক শুনিয়া পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে কে তার নাম ধরিয়া ডাকে! কিন্তুু নিলু উহাকে চিনিতে পারিল না! রৌদ্রতাপে জীবন অস্হির হইয়া আসিয়াছে, প্রাণ যায় যায় অবস্থা! মোহন লাল কাছে আসিয়া নিলুকে জড়াইয়া ধরিল!
আট. নিলু এবার চিনিতে পারিল উহাকে বটে! মুখের কাছে আনিয়া নিলু কহিল, তুই মোহন লাল না। মোহন লাল বলিল, নিলু তুই আমাকে চিনিতে পারছিস না। নিলু কহিল মোহন লাল তোর চেহারার অনেক বিকৃতি ঘটিয়াছে। দুই বছর আগের মোহন লালের মাঝে অনেক পরির্বতন হইছে! নিলু কহিলেন, কিরে মোহন লাল তোর চেহারার কি হাল করিয়াছিস! মোহন লাল কোন কথা না বলিয়া চুপ হইয়া দাঁড়িয়ে থাকিলে! মোহন লাল ছাড়া যে আর কেউ জানে না তার পরিবারের বর্তমান অবস্থা!
বড় বোনের বিবাহ দিয়া মোহন লালের পরিবার এক বারে সর্বশান্ত হইবার. উপক্রম হইছে! যে টুকু জমি ছিল তা জৈষ্ঠ্য মাসের দারুণ খরায় সব জমির ধান পুড়ে ছাই হইয়াছে! পেটের দায়ে ও পরিবারের কথা চিন্তা করিয়া মহাজনের সাথে গুদাম ঘরে কাজ করিতে হয় সকাল থাকিয়া রাত পর্যন্ত! কয়েক দিন থাকিয়া মোহন লালের শরীল টা ভাল যাইতেছে না! দিনের বেলা ভাল থাকিলে ও,
রাতের বেলায় ঠিক শরীলের মধ্যে জ্বর আসিয়া পড়ে ! সারা শরীল জ্বরে পুড়ে যায়, রাত্রি বেলা ঘুম ঠিক মত হয় না! কি করিবে মোহন লাল উপায় ঠিক খুঁজে পাইতেছে না! ডাক্তার সে যে দেখাবে অত টাকা কড়ি তার কাছে নেই! এভাবে চলতে থাকলে হয় তো মোহন লালের জীবনে কালো অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে! কিন্তুু উপায় তো নাই, কাজ না করিলে যে অনাহারে থাকিতে হইবে।
যদি মরন হয় হোক তবু এর শেষ কোথায় তা দেখে নেবে মোহন লাল। কাল সকাল বেলা একবার মহাজনকে অনুরোধ করিয়া দেখিবে, যে অগ্রিম কিছু টাকা নেওয়া যায় কি না? মোহন লাল আবার মনে মনে ভাবিলেন, মহাজন যে হাড়কিপটে সে যে টাকা দিবে তা বলা বাহুল্য! সুদের টাকা দিয়ে কিপটে মহাজন কত যে কি করল তা হিসাব নেই! যদি অগ্রিম টাকা না দেয়, তাহলে সুদের উপর টাকা নিবে সে!
সুদের উপর টাকা চাইলে হয় তো লোভে পড়িয়া টাকা সে নিশ্চয় দিবে! থাক সে কথা কালকে দেখা যাবে। মোহন লাল এমনি কথা ভাবিতেছে! নিলু বলিল, কিরে মোহন লাল তুই দেখি স্বর্গের রাজ্যে হারিয়ে গেলি! মোহন লাল মৃদু হাঁসিল বলিল, গরীব মানুষের আবার স্বর্গ নরগ দুটোই সমান! সেটা কার জীবনে কখন আছে কেউ বুঝতে পারে না!
নয়. নিলু কহিল, থাক স্বর্গ নরগের কথা। নিলু মোহন লালকে প্রশ্ন করিল, কিরে মোহন লাল কোথায় গিয়েছিলি তুই " মোহন লাল গম্ভীর গলায় বলল, রাখাল দাসকে তুই. চিনিস না। নিলু কহিল যে রাখাল দাস আমারে নদীর স্রোত থাকিয়া প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল! মোহন লাল মাথা নেড়ে কহিলেন, জি সেই রাখাল দাস।
নিলু বলিল, রাখাল দাসের. অসুখের কথা আমি শুনেছি সুর্দশনার কাছে! মোহন লাল কহিল, সুর্দশনাকে তুই কোথায় দেখলি নিলু! নিলু বলিল কেন রাস্তার পাশে শিমুল তলে! তার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে, সুর্দশনাকে আমি বিবাহ করিতে চাই! মোহন কহিল মেয়ে কি গ্রামে আকাল পড়িয়া গিয়াছে! নিলু বলিল, না রে মোহন লাল আাকাল পড়বে কেন!
মোহন লাল কহিলেন, তাহলে নিলু তুই সুর্দশনাকে বিবাহ করিতে চাস কিছের জন্য! নাকি তার বাপের টাকা কড়ির জন্য! সুর্দশনার বাপের তো টাকা পয়সা কিছু নাই!
তাহলে কিসের জন্য এত পাগল হইছিস আমারে বল দেখি! শুনি কি আছে সুর্দশনার দেহের মাঝে! নিলু তুই কি জানিস না সুর্দশনার বিয়ে হয়েছে জমিদারের ছেলের সহিত। নিলু কহিল, সুর্দশনার মত এমন সুন্দরী রমনী এ গ্রামে আর একটা আছে মোহন লাল!মস্তকের দীর্ঘ কৃষ বেনী ,মায়াবী দুটি আঁখি! মোহন লাল বলিল, না এ গ্রামে সুর্দশনার মত আর কোন নারী নেই! নিলু কহিল, রাখাল দাসের এমন কি রোগ হয়েছে যা কিছুতেই সেরে উঠে না! ডাক্তার বাবু কহিছে রাখাল দাসের কোন রোগ ব্যাধি হয় নাই! কিন্তুু রাখাল দাসের অবস্থা দেখিয়া মনে হইতেছে রাখাল দাসের কঠিন ব্যামো বাধিয়াছে!
রাখাল দাস এখন কাউ কে চিনিতে পারে না এবং ঠিক মত খেতে পারে না! যদি জোর করিয়া কিছু তাহাকে খাইয়ে দেওয়া হয়! সঙ্গে সঙ্গে বমি করিয়া সব বের করিয়া দেয়! নিলু কহিল, মোহন লাল কতদিন ধরিয়া এমন অবস্থা রাখাল দাসের। মোহন লাল বলিল, প্রায় তিন চার মাস ধরিয়া তার এমন করুণ অবস্থা। যে রাখাল দাস সারাদিন মাটে ঘাটে মাতিয়া বেড়াইতো সে এখন কিনা বিছানায় মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে!
দশ. রাখাল দাসকে দেখিলে বুকের ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠে! রাখালের জন্য কিছু যে সাহায্য করিব সে সাধ্য আর রহিল না! নিলু কহিল শহর থাকি আসিয়া তোরে খুঁজিয়া হয়রান হইয়াছি! মোহন লাল তোরে খুঁজি না পাইয়া বাড়ি চলিয়া যাইতেছি, অনেক খিদে পাইছে তো! মোহন লাল কহিল, নিলু যা বাড়ি গিয়ে পেট ভরিয়ে খেয়ে নে পরে দেখা হইবে!
মোহন লালের আদেশ পাইয়া নিলু তীব্র রোদে গৃহে গমন করিল! মোহন লাল আর দেরি করল না সরু পথ ধরিয়া বাড়ি চলে গেল! নিলু মোহন লালের কথা চিন্তা করিতেছে, যে মোহন লালের পরিবারের এমন অবস্থা মন
খুব খারাপ লাগল! মোহন লাল সেই শৈশব কালেরবন্ধু!
তাহার এমন দুরর্দশা দেখিয়া মনে মনে ভাবিল মোহন লালকে শহরে নিয়ে যাইবে! মোহন লাল তো পড়াশুনা বেশি জানে না সেই যে পন্ডিত মশাইয়ের বেতের মার খেয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করিল আর কোন দিন বিদ্যালয় মুখে গমন করে নাই! বরং পন্ডিত মশাই কে পথে দেখা হইলে কত কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করত! থাক এসব কথা পরে দেখা যাবে কি করা যায়! এসব কথা সারাটি পথ ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির দরজার কাছে আসিয়াছে নিলু নিজেই জানে না।
বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করবে এমন সময় তার বাপকে দেখিতে পাইল! নিলুর বাপ বিক্রম চক্রবর্তী চেয়ারে বসিয়া কি যেন ভাবিতেছে! নিলুর মা কাসার থাল হাতে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলিয়া যাইতেছে। নিলুর মা ছিল অন্য জাতের মেয়ে! বিক্রম চক্রেবর্তনীর প্রেমের টানে ঘর ছাড়িয়া পালিয়ে আসে!
এগার. আজ অব্দি কাননের বাপ তার মেয়ের খোঁজ খবর নেই নাই! লোকের কাছ থাকিয়া পরে জানিতে পারিয়াছে যে তাহার মেয়ে মুচির ছেলেকে ভালোবাসিত অনেক দিন ধরিয়া। কানন বালা ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র কন্যা সন্তান! কানন বালা আদরের মেয়ে বলিয়া কানন বালাকে কেউ কিছু বলিত না। যখন যা খুঁশি করিয়া বেড়াই তো! কেউ কানন বালাকে কিছু বলিত না, কোন কাজে বাধা দিত না!
মেয়েকে আদর করিয়া তাহার পরিবার মাথায় তুলিয়া রাখিত! মেয়েকে শাসন না করিয়া তাহারা যে কত ভুল করিয়াছে! কানন বালার কথা হয়তো তার পরিবার ভুলে গেছে! নিলু তার মাকে একদিন বলে মা, এবার পুজায় মামার বাড়ি যাইবানা! নিলুর মা কোন কথা বলে না, চুপ হইয়া দাঁড়িয়ে থাকে! কানন বালার দুই চোখ বেড়ে অঝরে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল। নিলু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে তার মায়ের দিকে!
নিলু ছোট্ট থাকিয়া একদিন ও তার মামার বাড়ি যায় নাই! নিলু তো নিজেই জানে না তার মামা বাড়ি কোন গ্রামে! নিলু তার মা কানন বালাকে বলে মা, মামা বাড়ির কথা বলল তুই কাঁদিস কেন! নিলু বলিল, মা তাহারা কি কেউ বেঁচে নাই, নিলুুর মা কানন বালা কহিল, আমি তা কহিতে পারি নে নিলু! সেই দিন থাকিয়া নিলু একদিনের তরে তার মাকে জিজ্ঞেস করে নাই মামা বাড়ির কথা! নিলু তার বাপকে বাহির বসিয়া থাকিতে দেখে ধীরগতিতে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল!
নিলুর মা রান্না ঘর থাকিয়া বের হইল! এমন সময় নিলুর বাপ ডাকিয়া কহিল কিরে রান্না বান্না শেষ হইল নাকি! বেলা যে দুপুর হইয়া গেল,আর কত সময় লাগবে! নিলুর মা কানন বালা কহিলেন, কিরে নিলু এত বেলায় বাড়ি ফিরলি যে বেলা কত হয়েছে সে খেয়াল আছে! নিলু বলিল, আমি জানি বেলা দুপুর হইয়া আসিয়াছে! নিলুর বাপ চোখ মেলে দেখে কে এসেছে নিলু, তা আসার দরকার কি ছিল! তা নবাব জাদা কোন রাজ্যে জয় করিয়া ঘরে ফিরলে! নিলুর মা কানন বালা কহিলেন, নিলু কত দিন পর গ্রামে আসিয়াছে সে কি ঘরের মধ্যে বসিয়া থাকিবে।
বার. নিলুর বাপ বিক্রম রাগ হইয়া বলিল তোমার আসকারা পাইয়া ছেলে এমন হইছে! পরে বুঝিবে ছেলেকে শাসন না করিলে কিরুপ হইয়া দাঁড়ায়! নিলুর মা কানন বালা কহিলেন, একমাত্র ছেলেকে আর কি বলি! নিলু তো কোন অপরাধ করে নাই, সে কি আর ছোট বাচ্চা আছে! নিলু তার মায়ের কাছে বড় আদরের ছেলে! নিলু যখন শহরে থাকে কানন বালা বড়ই চিন্তিত থাকে! শহরে ছেলে কি খায় বা কেমনে থাকে!
নিলু তার মাকে বলিল, মা রান্নাবান্ন শেষ হয়েছে! কানন বালা বলিল, কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে বাপ! কানন বালা কহিল, নিলু যা তাড়াতাড়ি স্রান করিয়া আয়! নিলু মায়ের আদেশ পেয়ে ঘরের ভিতরে চলিয়া গেল! সুর্দশনা বাড়ি গিয়ে উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছে! হয়তো নিলুর কথা তার মনে ধরেছে, এমন কথাই সুর্দশনা চিন্তা করিতেছে! সুর্দশনার মা দুর থাকিয়া তারে দেখতে পেল যে সুর্দশনা হয়তো কিছু ভাবছে!
সুর্দশনা মা কাছে আসিয়া কহিল, সুর্দশনা কি হয়েছে মা তোর খুলে বল আমাকে! সুর্দশনা পিছনে ফিরে দেখে তার মা! সুর্দশনা তার মাকে দেখিয়া কেঁদে ফেলল! অঝর ধারায় কাঁদতে লাগল সুর্দশনা! সুর্দশনা দৌড়ে গিয়ে তার মা, কে জড়িয়ে ধরল! সুর্দশনার মা কহিলেন, কি হয়েছে মা সুর্দশনা খুলে বল আমাকে আমি না তোর মা! সুর্দশনা তার মা কে বলিল, আমি আর স্বামী বাড়ি যাইব না! সুর্দশনার মা রাগ হইয়া বলিল, কি কইলি হারাম জাদী তুই স্বামীর বাড়ি যাইবি না! সুর্দশনা তার মায়ের কথা শুনিয়া মাথা নিচু করিয়া রহিল! অনঃপর সুর্দশনা মাথা নিচু করিয়া ঘরের ভিতরে চলে গেল!
দুই দিন যাবৎ মহাজন তার দোকানে যাইনি, কয়েক দিন বিশ্রামে ছিলেন! মহাজনের শরীল তেমন একটা ভাল যাইতেছে না! তাই দোকান দুই দিন এক বারে খুলে নাই! ভাল ও সৎ লোক দেখিয়া একটা যে লোক রাখবে সে সব ব্যবসার হিসাব রাখবে! মহাজন সাহস পায় না যদি টাকা চুরি করিয়া পালিয়ে যায়! আর এ জগতে এমন লোক হাজার হাজার আছে! এরুপ কথা ভাবিয়া মহাজন দোকানে লোক রাখে নাই! কিছু লোক আছে যারা দিন মজুরের কাজ করে!
তের. মোহন লাল বাড়ি গিয়ে মাকে বলছে মা নিলু শহর থাকিয়া গ্রামে ফিরে এসেছে! মা আমি ও নিলুর সাথে শহরে যাব, শহরে গিয়ে চাকরি করব! দেখবে তাহলে আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না! মোহন লালের মা বলিল, দেখ মোহন লাল নিলু তোরে নিয়ে যায় কিনা!
মোহন লাল কহিল, মা নিলু আমার বাল্য কালের বন্ধু আমি কইলে সে না করতে পারবে না! মোহন লালের মা কহিল, দেখ তোর বাপ এখন আর তেমন কাজ করতে পারে না! বয়স অনেক হইয়া গেছে এই বয়সে যে কাজ করছে এটাই তো বেশি!
মোহন লাল বলিল, মা খুব খিদে পাইছে কিছু খেতে দাও! মা বাবা কই গেছে, তারে তো দেখি না সকাল থেকে! মোহনের মা বলিল, তোর বাপ গেছে মহাজনের কাছে কিছু টাকা আনতে! কয়েক দিন ধরে মেয়ের বাড়ি যাইবে ভাবছে কিন্তুু টাকার অভাবে যেতে পারছে না! তোর বোন খবর পাঠিয়েছে যে তার বাপকে একবার হইলে তার মেয়ে কে দেখে যাইতে! মেয়েটার নাকি ভীষণ অসুখ করেছে, জামাই বাড়িতে নাই শহরে গেছে কোন এক কাজে!
এমনিতেই মেয়েটা অসুস্থ তার উপর আবার ছোট্ট বাচ্চাকে সামলানো কতই কষ্ট না হচ্ছে! মোহন লাল কহিলেন, মা দিদির শ্বাশুড়ী আছে সে দেখা শুনা করে না! মোহনের মা বলিল, দেখা শুনা করে কি হবে যদি ওষুধ না খেতে পারে! মোহন কহিল, কেন আমি বলেছিলাম না দিদি রে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া যাবে না! কত টাকা ও দিলাম আজ আবার দিদির এত দুরদর্শা খুব খারাপ লাগছে!
মোহনের মা বলিল, যাক বাপ যা হবার তো হয়ে গেছে মেয়েটার কোন কিছু না হলেই হয়! আয় বস ভাত খেয়ে নে কত বেলা হয়েছে, শরীল টা কেমন শুখে গেছে মোহন কোন অসুখ হয় নাই তো আবার। মোহন কহিল, রাতে বেলা করিয়া একটু জ্বর আসে সকালে আর থাকে না!
চৌদ্দ. মোহন লালের মা কহিলেন, দেখ মোহন লাল ওষুধ না খেলে কিন্তুু জ্বর কমবে না! ওষুদ না খেয়ে রাখাল দাশের আজ এই পরিণতি! ছেলেটা জ্বর হইলেও ওষুধ কিনে খাইত না! বাপ মা যদি জোর করতো সে কথা কানে নিত না! মোহন লাল হাত ধুয়ে ভাত খেতে বসেছে, এমন সময় মোহন লালের বাপ এসে হাজির হইল!
মোহন লালের বাপের চেহারার মাঝে মলিন বিষাদের কালো ছায়া! চোখ দিয়ে জল পড়ে যায় এমন অবস্থা '' ছোট বাচ্চা ছেলে হইলে হয়তো কেঁদে ফেলত! আঙিনায় এসে বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে পড়ল, কোন কথা বলিল না কাহারো ও সহিত! মোহন লালের মা দৌড়ে গিয়ে বলিল কি হয়েছে আপনার শুয়ে পড়লেন যে, জল এনে দিব নাকি !
মোহন লালকে চিৎকার করিয়া ডাক দিল, মোহন লাল এক গ্লাস জল নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি! মোহন লাল তার মায়ের ডাক শুনে জল নিয়ে গেল !
মোহনের মা ডাক দিল ওঠো জল খেয়ে নেও কি হয়েছে আপনার একটু খুলে বলেন শুনি!
অনেক পরে মোহন লালের বাপ চোখ খুলিল, এবার সে চৌতন্য হইল!
মোহন লালের মা কহিল, আপনার কি হয়েছে এমন করিতেছেন কেন!
মোহন লালের বাপ ঘরের চারিদিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল, কিছুই বলিল না!
এমন দৃষ্টি ভঙ্গি করিয়া চেয়ে রহিল যেন তার অমূল্য ধন খুঁজিতেছে!
মোহন লালের মা রাধারানী বলিল, আপনার কি হয়েছে, এই বলিয়া কাঁন্না শুরু করিয়া দিল!
দুই চোখ বেয়ে ঝড়তে লাগল চোখের জল!
রাধারানী মোহন লাল কে কহিলেন, মোহন লাল তোর কাকা রে, একটু ডাক দে, তোর বাপের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না! মায়ের আদেশ পেয়ে মোহন লাল
আঙিনা থাকিয়া বাহিরে চলিয়া গেল!
মোহন লাল দের বাড়ির পিছনে তার কাকার ঘর, মোহন লাল আঙিনায় প্রবেশ না করতেই একটা ডাক দিল কাকা ঘরে আছ নাকি!
মোহন লালের কাকি মা রান্না ঘর থাকিয়া বাহিরে বের হইল, তারপর মোহন কে জিজ্ঞেস করিল কি হয়েছে মোহন তোর কাকা রে, ডাকো কিসের জন্য!
মোহন গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না, কাঁন্না গলায় বলিল, বাপের অবস্থা ভীষণ খারাপ কেমন জানি করিতেছে! মোহনের একাকি মা কহিলেন, কি বলিস রে, মোহন লাল আবার কি হইল তোর বাপের!
মোহনের কাকি মা কহিল, তোর কাকা তো ঘরে নেই, সেই সকাল বেলায় বাহিরে চলিয়া গিয়াছে এখন অব্দি ঘরে ফিরে আসে নাই!
পনের. মোহন লাল কহিলেন, কোথায় গমন করিয়াছে কাকা বলিয়া গিয়েছি কি!
মোহন লালের কাকি মা বলিল, না রে মোহন তা তো বলিয়া যায় নাই!
মোহনের কাকি মা কহিলেন, শিগগির বাড়ি চল দেখি কি অবস্থা তোর বাপের
চল শিগগির চল, মোহন লাল!
এই কথা বলিয়া মোহন তার কাকি মাকে, নিয়ে বাড়ি ফিরে আসিল!
তখন ও মোহন লালের বাপের অবস্থা খারাপের দিকে পরিণত হইতে লাগিল কি যে এক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেল!
নিলু স্রান করিয়া মাথা চুল গুলো গামছা দিয়ে মুছে নিচ্ছে, নিলুর বাপ বিক্রম কহিলেন, কি, রে নিলু আর কতক্ষণ সময় লাগবে তোর ভাত যে ঠান্ডা হইয়া গেল!
নিলু বলিল, আমি আসিতেছি আর একটু সময় লাগবে!
বিক্রম নিলুর মা,কে ডাকিল, কোথায় গেলি রে ভাত দে বলিয়া চুপ হইয়া গেল!
আজ অনেক দিন পর বাপ ছেলে মিলে ভাত খাবে, ভাত খেতে বসলেই নিলুর মা কাঁন্না করত ছেলের জন্য! শহরে থাকিয়া ছেলে গ্রামে ফিরিয়া আসিল, মায়ের কোলে নিলু ফিরে এসেছে!
হয় তো দুই একদিন নিলু গ্রামের মধ্যে অবস্থান করিবে, সময় ফুরিয়ে গেলে নিশ্চয় সে শহরে চলিয়া যাইবে!
নিলু স্রান শেষে রান্না ঘরে চলে এল, এসে দেখে তার বাপ ভাতের থালা নিয়ে বসিয়া আছে!
নিলু কিন্তুু অবাক হইল না তার কারণ ছোট বেলা থাকিয়া দেখে আসিতেছে এক সাথে দিনে কিংবা রাতের খাবার এক সাথে খাইত!
নিলুকে আসতে দেখে বিক্রম চক্রবর্তী কানন বালাকে কহিলেন, ভাত দে নিলু বস!
ষোল. কানন বালা নিলুকে ভাত দিল তার থালার মধ্যে, কতদিন পরে নিলু গ্রামে আসিয়াছে শহরে ছেলেটা কি যে খায় কি যে রান্না করিয়া দেয়!
কয়েক মাসে নিলুর চেহারা অনেক খারাপ হইয়া গেছে মুখটা শুখিয়ে মলিন হয়ে গেছে!
নিলু যে কতদিন পরে মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাচ্ছে তা সে নিজেই জানে!
কানন বালা বলিলেন, নিলু শহর দেখতে কেমন রে বাবা আমারে নিয়ে যাবি শহরে! মনে বড় সাদ হয় শহরে গিয়ে তোর সাথে থাকি! সারাদিন বাড়িতে একা থাকি তুই শহরে কি খাস না খাস বড়ই চিন্তা হয় রে বাপ! কানন বালা আরো কহিলেন, নিলু নিজেই রান্না করিয়া খাস নাকি মেসে খাস বাপ!
নিলু মায়ের কথা শুনিয়া ভাত খাওয়া বন্ধ করিলেন! নিলু এখন মা,কে কি জবাব দিবে, যদি সে সত্যি কথা মা,কে বলে তাহলে হয়তো শহরে আর যেতে দিবে! মা জানে রান্না করে খাওয়া একজন ছেলের পক্ষে কত কষ্টের হইয়া যায়! যদি সে মা , কে বলে যে রান্না করিয়া সে নিজেই খায় !
নিলু যদি মা, কে বলে সে মেসে খায় তাহলে হয়তো কিছুই বলিবে না, আর যদি শুনে ছেলে রান্না করিয়া খায় কানন বালার মাথায় আঁকাশে ভেঙে পড়িবে!
নিলু একটু ভেবে মা, কে বলিল না মা আমি তো মেসে খাই!
কানন বালা বলিলেন যদি মেসে খাস তাহলে চেহারা শুকিয়ে যাচ্ছে ক্যান নিলু সময় মত খাওয়া দাওয়া করিস না নাকি!
নিলু মা,কে কহিলেন, না ঠিক মত খাই তো কিছুদিন আগে জ্বর হয়েছিল তাই চেহারা এমন হইয়া গেছে! কানন বালা কহিলেন কি জ্বর হয়েছিল কই আমারে তো জানাস নাই!
নিলু বলিল, মা আমি বাবাকে জানিয়েছি যে আমার জ্বর হয়েছে দুইদিন অফিসে যেতে পারিনি! কই তোর বাপে তো কিছুই জানাইনি আমারে আমি কি তোদের কাছে পর নাকি নিলু! নিলু মা, কে বলিল, না মা তোমাকে বলিলে তুমি চিন্তা করিতে পরে দেখতে আমার জন্য চিন্তা করিতে নিজেই অসুস্থ হইয়া পড়তে